বিশ্বে প্রথম জেনেরিক রেমডেসিভির
করোনার চিকিৎসায় দেশে প্রথম রেমডেসিভির উৎপাদন করল এসকেএফ
করোনার চিকিৎসায় ব্যবহৃত এসকেএফের তৈরি রেমিভির
এখন বাজারে আসার জন্য প্রস্তুত। ছবি: সংগৃহীত
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকর ওষুধ রেমডেসিভির উৎপাদন
সম্পন্ন করেছে দেশের খ্যাতনামা ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এসকেএফ
ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। উৎপাদনের সব প্রক্রিয়া শেষ করার পর
শুক্রবার সকাল থেকে শুরু হয়েছে সরবরাহ করার প্রস্তুতি।

গত ডিসেম্বরে শেষে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম
করোনাভাইরাসে আক্রান্তের খবর জানা যায়। প্রথমে চীনের কয়েকটি প্রদেশে, তারপর চীনের
প্রতিবেশী দেশগুলোতে এবং পরবর্তীতে এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় বিশ্ব
স্বাস্থ্য সংস্থা প্রথমে বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। পরে পরিস্থিতিকে
বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণা দেয়। করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে
প্রায় ৩৯ লাখ লোক আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছে ২ লাখ ৭০ হাজার।
স্বাভাবিকভাবে প্রাথমিক পরীক্ষায় উৎসাহব্যঞ্জক ফল পাওয়ায়
করোনা রোগীদের চিকিৎসায় মার্কিন প্রতিষ্ঠান গিলিয়েড সায়েন্সেস কোম্পানির তৈরি এই
ওষুধ সারা বিশ্বে সাড়া ফেলে। যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) গত
সপ্তাহে করোনার ওষুধ হিসেবে রেমডেসিভিরকে ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। জাপানের ওষুধ
প্রশাসন ৭ মে থেকে ওষুধটি করোনা রোগীদের ওপর প্রয়োগের অনুমতি দিয়েছে। তবে কবে নাগাদ
জাপান এর উৎপাদনে যাবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। মার্কিন
প্রতিষ্ঠান গিলিয়েড সায়েন্সেস ওষুধটি উৎপাদনের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের বড়
প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করছে বলেও খবরে জানা গেছে।
এ অবস্থায় এসকেএফ-ই বিশ্বে প্রথম ওষুধ প্রস্তুতকারী
প্রতিষ্ঠান,
যারা
জেনেরিক (মূল বা গোত্র) রেমডেসিভির উৎপাদন করতে সক্ষম হলো। এসকেএফের উৎপাদন
করা রেমডেসিভিরের বাণিজ্যিক নাম 'রেমিভির'। এসকেএফ জানিয়েছে, বিধি অনুযায়ী রেমডিসিভির নমুনা ঔষধ প্রশাসন
অধিদপ্তরের অধীনস্থ ন্যাশনাল কন্ট্রোল ল্যাবোরেটরিতে জমা দেওয়া হবে এবং ছাড়পত্র ও
বাজারজাতের অনুমতি পাওয়ার পর কিছু দিনের মধ্যেই ওষুধটি বিতরণ শুরু করবে এসকেএফ।
সিমিন হোসেন বলেন, 'ঔষধ প্রশাসন গত মার্চ মাসে ওষুধটি ব্যবহারের
অনুমতি দেয়। ঔষধ প্রশাসনের অনুমোদনের পরপরই আমাদের ফরমুলেশন বিজ্ঞানীরা
মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে রেমডেসিভির নিয়ে কাজ শুরু করেন। যেহেতু এটি একটি
শিরায় দেওয়া ইনজেকশন, সে কারণে এর উৎপাদনে সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। দুই মাস ধরে
এসকেএফ-কর্মীদের নিরলস পরিশ্রমের ফলেই এত কম সময়ে এটা উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। ওষুধের মূল
উপাদান সরবরাহকারীদের সঙ্গে চুক্তি করে পর্যাপ্ত কাঁচামাল প্রাপ্যতা নিশ্চিত করেছি
আমরা।'
করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ রোগের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে
বেশি কার্যকারিতা দেখিয়েছে রেমডেসিভির। গিলিয়েডের নিজস্ব পরীক্ষায় দেখা গেছে, এই ওষুধ
ব্যবহারে রোগীদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। মানুষের শিরায়
ইনজেকশন হিসেবে এই ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়। রোগের তীব্রতার
ওপর এর ডোজ নির্ভর করে। গুরুতর অসুস্থ রোগীদের জন্য ৫ অথবা ১০ দিনের ডোজ প্রয়োজন
হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মেডিসিন সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক
বিল্লাল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ কোনো কিছুতে পিছিয়ে থাকে না, ওষুধ উৎপাদনে তো
নয়ই। আশা করা যায়, বাংলাদেশ শুধু
এই ওষুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে না, রপ্তানিও করবে। ওষুধটি কীভাবে
কাজ করবে, জানতে চাইলে
তিনি বলেন,
যুক্তরাষ্ট্রের
বেশ কিছু হাসপাতালে ওষুধটি প্রয়োগ করে দেখা গেছে, খুবই সংকটাপন্ন রোগীর ওপর এটা কাজ করছে। রোগীরা দ্রুত
হাসপাতাল ছেড়েছেন এবং ভাইরাসের ঘনত্ব ওষুধটি কমিয়ে আনতে পারছে। ওষুধটি নিবিড়
পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন সংকটাপন্ন রোগীদের জন্য ভালো ফল দিয়েছে
যুক্তরাষ্ট্রে। যদিও এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাস প্রতিরোধী কোনো ওষুধ শতভাগ
কার্যকর, এমনটা বলা
যাচ্ছে না। তবে রেমডেসিভির ভালো কাজ করেছে।
অধ্যাপক বিল্লাল আলম আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের
ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) কোনো ওষুধের অনুমতি দিতে অন্তত ছয় মাস
সময় নেয়। কিন্তু ওষুধটির কার্যকারিতা দেখে দ্রুত অনুমতি দিয়েছে।
রেমডেসিভির উৎপাদনের একচেটিয়া স্বত্ব রয়েছে গিলিয়েডের। তবে আন্তর্জাতিক
বাণিজ্য আইন অনুযায়ী, জাতিসংঘ স্বীকৃত বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলো এসব
পেটেন্ট বা স্বত্ব অগ্রাহ্য করতে পারে। ফলে এসব দেশ সহনীয় মূল্যে ওষুধ উৎপাদন
করতে পারে। তবে এই ওষুধটি বর্তমানে খোলাবাজারে দেওয়া হবে না। এটা দেওয়া হবে
করোনা চিকিৎসার জন্য সরকার অনুমোদিত হাসপাতাল বা ক্লিনিককে।
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ও আমেরিকার
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসের পরিচালক অ্যান্থনি
এস ফাউসি হোয়াইট হাউসে এক আলোচনায় বলেন, করোনা থেকে দ্রুত সেরে ওঠার ক্ষেত্রে
রেমডেসিভিরের ইতিবাচক প্রভাব পরিষ্কার। আর এই ওষুধ যেহেতু কাজ করছে বলে
পরিষ্কার প্রমাণ মিলেছে, তখন তা দ্রুত মানুষকে জানানো নৈতিক বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সীতেশ
চন্দ্র বাছাড় এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, রেমডেসিভির ওষুধটি ইবোলা ভাইরাসের বিরুদ্ধে
দারুণ কার্যকর ছিল। সার্স ও মার্স ভাইরাসের বিরুদ্ধেও এটি ব্যবহৃত হয়েছে। মূলত
শ্বাসনালিতে সংক্রমিত ভাইরাসের বিরুদ্ধে ওষুধটি তার কার্যকারিতা দেখিয়েছে। এই ধারণা সামনে
রেখেই এটি করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ব্যবহারে অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান। বাংলাদেশেও এটি
ব্যবহারে বাধা নেই। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস শ্বাসনালিতে সংক্রমিত হয়। সেই কারণে
রেমডেসিভির ব্যবহারে যে পরীক্ষাগুলো চালানো হয়েছে, তার ফলাফল আশাব্যঞ্জক। তবে এটি এখনো 'পর্যবেক্ষণ' ও 'পরীক্ষামূলক' পর্যায়ে আছে। তারপরও দেখা
গেছে, এই ওষুধ ব্যবহার
করা হয়েছে এমন রোগীরা অন্য রোগীর তুলনায় অন্তত ৪ থেকে ৫ দিন আগে সুস্থ হয়েছেন। এটি একটি বড়
ব্যাপার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, এসকেএফসহ বেশ
কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে এই ওষুধ তৈরি করছে। এসকেএফ তৈরি করে
ফেলেছে। অন্যরা করছে। এটা ভালো খবর। করোনাভাইরাসের
যেখানে কোনো চিকিৎসা নেই, সেখানে এই ওষুধ বাংলাদেশে চলে আসায় খানিকটা আশাবাদী হওয়া
যায়।
উল্লেখ্য, শিল্পপতি লতিফুর
রহমানের নেতৃত্বাধীন ট্রান্সকম গ্রুপের অন্যতম প্রতিষ্ঠান এসকেএফ
ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ৩০ বছর ধরে ওষুধ উৎপাদন করে আসছে। প্রতিষ্ঠানটি
দেশের বাইরে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের ৩০টি দেশে ওষুধ
রপ্তানি করে আসছে।
Post a Comment